নোয়াখালীকে ট্রল করা তো খুব সাম্প্রতিক একটা বিনোদন। জাতির এক শ্রেণির মানুষের আসলে রুচিশীলতা নিয়ে একটা প্রশ্ন আছে৷ দেখবেন মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকের মত নাটক এখন কেউ দেখে না। মঞ্চনাট্য কেউ দেখে না। খোয়াবনামা বা চিলেকোঠার সেপাই এর মত উপন্যাসও এখন আর কেউ লেখে না আর পড়ে না। কারণ নিম্নরুচির জাতি বিনোদন খুঁজে পায় ঈদের ভাঁড়ামি ভরপুর নাটক, সিনেমা আর ফেইসবুক আনসেন্সর্ড গ্রুপে যৌন উত্তেজক পোস্ট খুঁজাখুঁজি করে। তারা নোয়াখালীকে ট্রল করে কিছু বিনোদন খুঁঁজবে এটাইতো স্বাভাবিক। এরা ১৯৭১ এ রিফিউজি হয়ে ভারতে পালায় গিয়েও আজ রোহিঙ্গা নিয়ে ট্রল করে। একজন আরেকজনকে ছোট করতে রোহিঙ্গা বলে ডাকে। এইরকম রেসিস্ট সাবস্ট্যান্সহীন জাতি দেখে হোয়াইট রেসিস্টরাও লজ্জা পাবে।
আঙ্গুবাড়ি নোয়াখালী রয়েল ডিষ্ট্রিক ভাই, সেনবাগ মাইজদী চৌমুহনী নাম হুইঞ্চোনি তোমরা ভাই?’ শুনে কি মনে হচ্ছে? আঞ্চলিক, বহুল পরিচিত নোয়াখালির একটা গান। আদৌ কি গানটাতে ট্রল করার মত কিংবা সার্কাজমের কোনো উপাদান আছে? উত্তর জানা সত্ত্বেও অজানা। কিন্তু জানা অজানার এই প্রশ্নের ভিড়ে আমরা কি জানি নোয়াখালিকে কেনো ট্রল করা হয়? কেনোই বা তাদের নিয়ে ট্রল করা উচিত নয়? চলুন নোয়াখালীর এই ট্রল হওয়া সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক….
নোয়াখালীকে নিয়ে ট্রলের কারণ
নোয়াখালীকে ট্রলের কোনো পোক্ত কারণ নেই বললেই চলে। ট্রল করার জন্য আমাদের দেশের মানুষেরা পোক্ত কারণের সন্ধানী কখনোই নয়। বিষয় পেলেই সেটা নিয়ে ট্রল করা শুরু করা আমাদের চিরায়ত স্বভাব। তবে বহুল শ্রবনীয় যেসব উল্ল্যেখযোগ্য কারন পাওয়া যায় সেগুলো হলো…
- ব্রিটিশ আমলে দুর্ভিক্ষকালীন সময়ে নোয়াখালীতে থাকা ইমাম-হুজুরগণ নাকি প্রতারণার মাধ্যমে কিছু জমি দখল করে নিয়েছিলো। সেই থেকে তাদের সম্পর্কে সবার একটা খারাপ ধারণা এসে যায় এবং মানুষ নোয়াখালীকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা আরম্ভ করে।
- দুর্ভিক্ষকালীন সময়ে নোয়াখালীর লোকেরা নিজেদের এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। (লালসালু)
- নোয়াখালীর মানুষের অদ্ভুত ভাষা এবং তারা নিজেই নিজেদেরকে নোয়াখাইল্ল্যা বলাটাও ট্রলের শিকার হবার একটি কারণ বলা যেতে পারে। তারা ‘প’ কে বলে ‘হ’। পানিকে বলে ‘হানি’। এইসব ছোটখাট ভাষাবিভ্রাট অনেকের হাসির উদ্রেক ঘটায় যা ট্রলে উৎসাহিত করে, যদিও তা অনুচিত।
- ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে পূর্ব বাংলার নোয়াখালীতেও এ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ায়। সে দুঃসময়ে মহাত্মা মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধী শান্তির বার্তা নিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে নোয়াখালীতে আসেন। ১৯৪৭ সালের ৭ নভেম্বর গান্ধীজি নোয়াখালীর প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র চৌমুহনী রেলস্টেশনে পদার্পন করে রেলওয়ে ময়দানে প্রথম জনসভা করেন। নোয়াখালীতে গান্ধীজি আসার সময় একটি ছাগল নিয়ে এসেছিলেন। আর নোয়াখালীর মানুষজন নাকি তার ছাগল চুরি করে খেয়ে ফেলেছিলো ! এজন্যও অনেকে নোয়াখালীকে ট্রল করে।
- ‘নোয়াখালী বিভাগ চাই’, ‘কুমিল্লাকে বিভাগ করা হলে মুতে ভাসিয়ে দিবো’ এরকম বিভাগ চাওয়া সম্পর্কিত হাজারো ট্রলে বিধ্বস্ত হয়েছিল নোয়াখালী। মূলত তাদের যৌক্তিক দাবীতে মানুষ ট্রল করতে উঠেপড়ে লেগেছিলো। এ কারন মূলত পূর্বের ঘটনাবলী।
এখন নোয়াখালিকে নিয়েই কেন ট্রল করে সেটা নোয়াখালীর একটা বদনাম আছে সেটা অবশ্যই স্বীকার করি। এই বদনামের পেছনে একটা ইতিহাস আছে যেটার জন্য নোয়াখালীর ভৌগোলিক অবস্থান, আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট দায়ী৷
নোয়াখালী একটি অনুর্বর চর এলাকা৷ এখানে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত উন্নত মানের ফসলের বাম্পার ফলন কম হয়৷ ধরুন ১০০ বছর আগে বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় যখন ৮০ শতাংশ লোক কৃষিকাজ করতো তখন নোয়াখালীরা কী করতো? তাদের কাজের খোঁজে নিজ এলাকা থেকে বের হয়ে যেতে হত। দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়তে হত।।
এই কারণে বাংলায় একটি পরিচিত বাক্য চাঁদের দেশেও নোয়াখাইল্লা পাওয়া যায়৷
এই যে বললাম বাঙালি একটা রেসিস্ট জাতি। ধরুন ফরিদপুরে আপনি বংশপরম্পরায় কৃষক। এখানে কোথা থেকে কয়েক নোয়াখাইল্লা উড়ে এসে জুড়ে বসলো। ভিন্ন ভাষায় কথা বলে। স্বাভাবিকভাবেই আপনি নোয়াখাইল্লাদের প্রতি একটু বিরূপ হবেন। চুরি করুক আর নাই করুক ডাকবেন নোয়াখাইল্লা গরু চোর কারণ তখন এটা আপনার মানসিক শান্তি এখন যেমন রোহিঙ্গা বলতে খালি অপরাধীই বুঝেন আপনারা।
আবার নোয়াখাইল্লারাও কম যেত না। যেহেতু খালি হাতে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে তার তো কিছু একটা করে খেতে হবে। আপনার মত আয়েস করার সময় তো তার নাই। তাই আপনি যেহেতু ভিনদেশি নোয়াখাইল্লা অপছন্দ করেন আপনি বলবেন এরা তো দাওয়াত খাইয়া দৌড় দেয়৷
উড়ে এসে জুড়ে বসা নোয়াখাইল্লা দাওয়াত খেয়ে দৌড় দিয়ে কাজ কর্ম করে বড়লোক হয়ে গেলে আর আপনি দাওয়াত খাওয়ার পর পান চিবুতে চিবুতে একটু নিদ্রা দিয়ে উঠে নোয়াখাইল্লার উন্নতি দেখে আবার বিরূপ হবেন।
তখন উপরের একটি উত্তরে এক ভাইয়ের কমেন্টের মত বলবেন
“নোয়াখালী মানুষ নিজেদের নিয়ে এক প্রকার বড়াই করে থাকে। ওরা দ্রুর্ত চালাক। যেমন ধরুণঃ আপনি একটি বেঞ্চে বন্ধুদের নিয়ে বসে আছেন। বেঞ্চের একটু জায়গা খালি আছে। আপনি যদি তাকে একটু বসতে দেন তো ও একটু একটু করে ঠেলতে ঠেলতে নিজের জায়গা করে নিবে। তারপর আবার নিজের দেশের অন্য কাউকে বসাবে। এভাবে করতে করতে আপনাকেই বেঞ্চ থেকে উঠিয়ে দিবে। তাই যা বলবেন, দেখে-শুনে-বুঝে-চলে বলবেন।”
যাই হোক, যেই সব নোয়াখাইল্লা সোজা রাস্তায় উপার্জনে ব্যর্থ হত তারা নিশ্চয়ই দুই নাম্বারি লাইন ধরতো উপরে উঠার ধান্দায়। লালসালুর মজিদ কিংবা পদ্মা নদীর হোসেন মাঝির চরিত্রেই তো তা উঠে এসেছে।
যাই হোক অতএব নোয়াখাইল্লাদের নিয়ে ট্রল হবার কারণ ঐতিহাসিক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট।